হঠাৎ করেই দেখলেন, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর আগেই আবার পিরিয়ড এসে হাজির? স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়টি যেকোনো নারীর জন্য প্রচণ্ড উদ্বেগের। মনের মধ্যে উঁকি দেয় হাজারো প্রশ্ন— "আমার শরীরে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?", "এটা কি স্বাভাবিক?", "কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?"।
আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত হন। মাসে দুবার পিরিয়ড বা ঘন ঘন মাসিক(১১-১৫ দিন পর পর) হওয়া অস্বাভাবিক হলেও এর পেছনে অনেক সাধারণ কারণ থাকতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা এই সমস্যার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে এর পেছনের সম্ভাব্য কারণ, ঝুঁকি এবং আপনার করণীয় সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আগে বুঝুন: স্বাভাবিক মাসিক চক্র কেমন হয়?
ঘন ঘন মাসিকের কারণ বোঝার আগে, একটি স্বাভাবিক মাসিক চক্র সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
- চক্রের সময়কাল: একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর স্বাভাবিক মাসিক চক্র সাধারণত ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হয়।
- রক্তপাতের সময়: রক্তপাত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
- ঘন ঘন মাসিক (Polymenorrhea): যখন আপনার মাসিক চক্র ২১ দিনেরও কম সময়ে বারবার ফিরে আসে, তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে "পলিমনোরিয়া" বলা হয়।
তবে মনে রাখবেন, বয়ঃসন্ধিকালে (Puberty) এবং মেনোপজের ঠিক আগের সময়ে (Perimenopause) হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে, যা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
মাসে দুবার পিরিয়ড: পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো
১. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা (Hormonal Imbalance)
পিরিয়ড চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক হলো ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন। এদের মাত্রার তারতম্য হলেই চক্রটি এলোমেলো হয়ে যায়।
- উচ্চ ইস্ট্রোজেন ও স্বল্প প্রোজেস্টেরন (High Estrogen & Low Progesterone): যদি শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমে যায়, তবে জরায়ুর প্রাচীর (Uterine Lining) দ্রুত পুরু হয়ে যায় এবং সময়ের আগেই ভেঙে গিয়ে রক্তপাত শুরু হয়।
- থাইরয়েডের সমস্যা: হাইপোথাইরয়েডিজম (কম থাইরয়েড হরমোন) বা হাইপারথাইরয়েডিজম (বেশি থাইরয়েড হরমোন) উভয়ই মাসিক চক্রকে সরাসরি প্রভাবিত করে।
- পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS): এটি একটি হরমোনজনিত সমস্যা যা ডিম্বাশয়ে সিস্ট তৈরি করে এবং অনিয়মিত পিরিয়ডের অন্যতম প্রধান কারণ।
২. জীবনযাত্রাজনিত কারণ (Lifestyle Factors)
আপনি হয়তো অবাক হবেন, কিন্তু আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও পিরিয়ডকে প্রভাবিত করতে পারে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ (Stress): অতিরিক্ত চাপ কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা পিরিয়ডের নিয়ন্ত্রক হরমোনগুলোর উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে।
- হঠাৎ ওজন পরিবর্তন: খুব দ্রুত ওজন বাড়লে বা কমলে শরীরের হরমোনাল সিস্টেমে ধাক্কা লাগে।
- অতিরিক্ত ব্যায়াম: শরীরচর্চা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত কঠোর ব্যায়াম পিরিয়ডকে অনিয়মিত করতে পারে।
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল (Birth Control Pill): নতুন পিল শুরু করলে, বন্ধ করলে বা এক ব্র্যান্ড থেকে অন্য ব্র্যান্ডে পরিবর্তন করলে প্রথম কয়েক মাস এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩. পুষ্টির ঘাটতি (Nutritional Deficiencies)
শরীরে কিছু প্রয়োজনীয় মিনারেলের অভাবও ঘন ঘন পিরিয়ডের কারণ হতে পারে।
- ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি (Magnesium Deficiency): ম্যাগনেসিয়াম প্রোজেস্টেরন হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর অভাবে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে।
- জিঙ্কের ঘাটতি (Zinc Deficiency): জিঙ্কও পিরিয়ড চক্রকে স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. শারীরিক ও অন্যান্য সমস্যা (Physical and Other Health Issues)
কিছু ক্ষেত্রে, ঘন ঘন মাসিকের পেছনে শারীরিক সমস্যাও থাকতে পারে।
- জরায়ুর ফাইব্রয়েড বা পলিপ (Uterine Fibroids or Polyps): এগুলি জরায়ুর ভেতরে বা তার আশেপাশে হওয়া নন-ক্যান্সারাস টিউমার যা অতিরিক্ত বা ঘন ঘন রক্তপাতের কারণ হতে পারে।
- পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID): প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ থেকেও অনিয়মিত রক্তপাত হতে পারে।
- গর্ভপাত (Miscarriage): অনেক সময় গর্ভধারণের প্রথম দিকেই গর্ভপাত হয়ে গেলে তাকে পিরিয়ড বলে ভুল হতে পারে।
- স্পটিং বনাম পিরিয়ড: অনেক সময় দুটি পিরিয়ডের মাঝামাঝি সময়ে (ওভুলেশনের সময়) হালকা রক্তপাত বা স্পটিং হয়। এটি কিন্তু পূর্ণাঙ্গ পিরিয়ড নয়। যদি রক্তপাতের পরিমাণ খুব কম থাকে এবং ১-২ দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, তবে এটি স্পটিং হতে পারে।
অবহেলা নয়! এই লক্ষণগুলো দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান
- যদি টানা দুই বা তিন মাস ধরে আপনার পিরিয়ড ২১ দিনের আগেই হয়ে যায়।
- রক্তপাতের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হলে (যদি প্রতি ১-২ ঘণ্টায় প্যাড বা ট্যাম্পন বদলাতে হয়)।
- তলপেটে অসহ্য ব্যথা বা ক্র্যাম্প হলে।
- দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা ফ্যাকাসে চেহারার মতো লক্ষণ দেখা দিলে (এটি রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ার লক্ষণ হতে পারে)।
- শারীরিক মিলনের পর যদি রক্তপাত হয়।
ঘন ঘন মাসিকের সমস্যা: কী করবেন এবং কী করবেন না
ঘরোয়া যত্ন ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
- পিরিয়ড ট্র্যাকিং: একটি ক্যালেন্ডার বা অ্যাপের সাহায্যে আপনার মাসিক চক্রের দিন এবং রক্তপাতের ধরন নোট করুন। এটি চিকিৎসকের কাছে গেলে খুব কাজে দেবে।
- স্ট্রেস কমানো: নিয়মিত মেডিটেশন, যোগা, পছন্দের গান শোনা বা বই পড়ার মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- সুষম খাবার: আয়রন সমৃদ্ধ খাবার (পালং শাক, কচু, ডিম, মাংস), ম্যাগনেসিয়াম (ডার্ক চকলেট, বাদাম, বীজ) এবং জিঙ্ক (কুমড়োর বীজ, ডাল) আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
ডাক্তারি পরীক্ষা ও চিকিৎসা
চিকিৎসক আপনার সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য কিছু পরীক্ষা করতে পারেন, যেমন:
- রক্ত পরীক্ষা (হরমোন এবং থাইরয়েডের মাত্রা দেখার জন্য)।
- পেটের আলট্রাসাউন্ড (জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের সমস্যা দেখতে)।
কারণ অনুযায়ী, চিকিৎসক আপনাকে হরমোনাল পিল, জীবনযাত্রার পরিবর্তনের পরামর্শ বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা দিতে পারেন।
শেষ কথা
মাসে দুবার পিরিয়ড হওয়াটা ভীতিকর হতে পারে, কিন্তু এর বেশিরভাগ কারণই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজের শরীরকে বোঝা এবং তার পরিবর্তনে মনোযোগ দেওয়া। আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক তথ্য জানুন এবং প্রয়োজনে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
আপনার শরীর আপনার সেরা বন্ধু; তার কথা শুনুন এবং সঠিক যত্ন নিন।Mumina Blogs এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!!
সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ Section)
প্রশ্ন ১: স্ট্রেসের কারণে কি মাসে দুবার পিরিয়ড হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের হরমোন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে, যার ফলে মাসিক চক্র অনিয়মিত হতে পারে এবং ঘন ঘন পিরিয়ড হতে পারে।
প্রশ্ন ২: ঘন ঘন পিরিয়ড কি গর্ভধারণে সমস্যা করতে পারে?
উত্তর: ঘন ঘন পিরিয়ডের পেছনের কারণটি গর্ভধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন PCOS বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থাকলে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। তাই এই সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৩: কিশোরী বয়সে মাসে দুবার পিরিয়ড হওয়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, পিরিয়ড শুরুর প্রথম কয়েক বছর হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে বলে মাসিক চক্র অনিয়মিত হতে পারে। তাই কিশোরী বয়সে মাঝে মাঝে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে এটি একটানা চলতে থাকলে চিকিৎসকের সাথে কথা বলা ভালো।
প্রশ্ন ৪: পিরিয়ড ভেবে যা হচ্ছে, তা কি স্পটিং হতে পারে? কীভাবে বুঝব?
উত্তর: যদি রক্তপাত খুব হালকা হয়, রঙ বাদামী বা হালকা গোলাপি হয় এবং মাত্র ১-২ দিন স্থায়ী হয়, তবে এটি পিরিয়ড না হয়ে স্পটিং হতে পারে। অন্যদিকে, পিরিয়ডের রক্তপাত তুলনামূলকভাবে বেশি এবং কয়েকদিন স্থায়ী হয়।