বর্ষাকালে অতিরিক্ত চুল পড়া? জানুন কারণ এবং প্রতিরোধের A-Z গাইড!(Monsoon hair fall)

আকাশে কালো মেঘ আর ঝুম বৃষ্টি—বর্ষার  এমন আবহাওয়া কার না ভালো লাগে! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখাটা যেন এক আলাদা অনুভূতি। কিন্তু এই সুন্দর ঋতুটি যখন আমাদের চুলের জন্য একটি দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়, তখন দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আয়নার সামনে দাঁড়ালে বা চিরুনি চালানোর পর একগুচ্ছ চুল দেখে কি আপনারও মন খারাপ হয়ে যায়?

বর্ষাকালে অতিরিক্ত চুল পড়া? জানুন কারণ এবং প্রতিরোধের A-Z গাইড! Monsoon hair fall

যদি আপনার উত্তর "হ্যাঁ" হয়, তবে আপনি একা নন। বর্ষাকালে চুল পড়া একটি খুবই সাধারণ সমস্যা। তবে ভালো খবর হলো, সঠিক যত্ন এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এই সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

চিন্তা করবেন না, আজ আমরা এই আর্টিকেলে বর্ষায় চুল পড়ার (Monsoon hair fall) পেছনের বিজ্ঞানসম্মত কারণগুলো জানার পাশাপাশি এর থেকে মুক্তির সহজ ও কার্যকরী উপায়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন, এই বর্ষায় চুলকে দিই নতুন জীবন!


💐বর্ষাকালে চুল কেন বেশি পড়ে? (কারণসমূহ)

বর্ষাকালে আমাদের চুল পড়ার হার প্রায় ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু কেন? এর পেছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।


🎀বাতাসে অতিরিক্ত আর্দ্রতা (Increased Humidity)

বর্ষাকালে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত আর্দ্রতা আমাদের চুলের কেরাটিন (Keratin) নামক প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে এবং চুলের স্বাভাবিক গঠন দুর্বল করে দেয়। চুল বাতাস থেকে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প শোষণ করে ফুলে ওঠে, যার ফলে চুলের কিউটিকল (বাইরের স্তর) খুলে যায়। এটি চুলকে রুক্ষ, ভঙ্গুর এবং দুর্বল করে তোলে, যার ফলে সামান্য আঘাতেই চুল ঝরে পড়ে।


🎀স্ক্যাল্পের ফাঙ্গাল ইনফেকশন ও খুশকি (Scalp Infections & Dandruff)

স্যাঁতসেঁতে ও আর্দ্র আবহাওয়া হলো ফাঙ্গাস এবং ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ। বর্ষাকালে আমাদের মাথার ত্বক বা স্ক্যাল্প অনেক সময় ভেজা থাকে, যা ফাঙ্গাল ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলে ম্যালাসেজিয়া (Malassezia) নামক এক ধরনের ইস্টের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা খুশকি, স্ক্যাল্পে চুলকানি এবং লালচে ভাব তৈরি করে। এই ইনফেকশনগুলো চুলের ফলিকল বা গোড়াকে দুর্বল করে দেয় এবং চুল পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


🎀বৃষ্টির জলের রাসায়নিক প্রভাব (Chemical Effect of Rainwater)

আমরা অনেকেই ভাবি বৃষ্টির জল নিরাপদ , কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বাতাসের নানা দূষিত পদার্থ, ধূলিকণা এবং রাসায়নিক বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যায়, যা একে অ্যাসিডিক করে তোলে। এই দূষিত বা অ্যাসিডিক জল যখন সরাসরি আমাদের চুলে লাগে, তখন এটি স্ক্যাল্পের স্বাভাবিক pH ব্যালেন্স নষ্ট করে দেয়। ফলে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায় এবং চুল পড়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।


🎀 ভেজা চুল ও তার দুর্বলতা (Weakness of Wet Hair)

ভেজা অবস্থায় চুলের গোড়া সবচেয়ে বেশি নরম ও দুর্বল থাকে। বর্ষায় আবহাওয়া আর্দ্র থাকায় চুল শুকাতে অনেক বেশি সময় লাগে। এই ভেজা চুল আঁচড়ালে বা তোয়ালে দিয়ে জোরে ঘষলে চুলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়, যা চুল ছিঁড়ে যাওয়া এবং ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।


💐বর্ষায় চুল পড়া বন্ধ করার ১০টি কার্যকরী উপায়:

  1. সঠিক শ্যাম্পু নির্বাচন করুন: বর্ষাকালে একটি মাইল্ড, সালফেট-ফ্রি এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান (যেমন—কেটোকোনাজোল বা জিংক পাইরিথিয়ন) যুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। এটি স্ক্যাল্পকে পরিষ্কার রাখবে এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন থেকে দূরে রাখবে। সপ্তাহে ২-৩ বারের বেশি শ্যাম্পু করবেন না, কারণ অতিরিক্ত শ্যাম্পু স্ক্যাল্পের প্রাকৃতিক তেল কেড়ে নেয়।
  2. কন্ডিশনারের সঠিক ব্যবহার করুন: শ্যাম্পুর পর অবশ্যই একটি ভালো কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। এটি চুলের কিউটিকল বন্ধ করে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং চুলকে মসৃণ রাখে। মনে রাখবেন, কন্ডিশনার স্ক্যাল্পে নয়, শুধু চুলের দৈর্ঘ্যে এবং আগায় লাগাবেন।
  3. চুল শুকনো রাখা আপনার প্রথম কাজ: বর্ষায় চুল ভেজা রাখা একদমই চলবে না। বৃষ্টিতে ভিজলে যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার জল দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন এবং একটি নরম মাইক্রোফাইবারের তোয়ালে দিয়ে আলতো করে চেপে চেপে চুল শুকিয়ে নিন। ভেজা চুল আঁচড়ানো বা শক্ত করে বাঁধা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।
  4. সঠিক চিরুনি ব্যবহার করুন: চুলের জট ছাড়ানোর জন্য সবসময় মোটা দাঁতের কাঠের চিরুনি ব্যবহার করুন। প্লাস্টিকের চিরুনি চুলে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি করে, যা চুলকে আরও ভঙ্গুর করে তোলে। জট ছাড়ানোর সময় নিচ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে উপরের দিকে আঁচড়ান।
  5. তেল দিয়ে মাসাজ করুন: সপ্তাহে অন্তত দুবার হালকা গরম তেল দিয়ে স্ক্যাল্প মাসাজ করুন। নারকেল তেল, আমন্ড অয়েল বা অলিভ অয়েলের সাথে কয়েক ফোঁটা টি-ট্রি অয়েল মিশিয়ে মাসাজ করলে এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়াবে, চুলের গোড়া মজবুত করবে এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন প্রতিরোধ করবে।
  6. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন: চুলের স্বাস্থ্য অনেকাংশে নির্ভর করে আপনার খাবারের ওপর। আপনার খাদ্যতালিকায় প্রোটিন (ডিম, ডাল, মাছ, পনির), আয়রন (পালং শাক, খেজুর, বিট), ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড, আখরোট) এবং বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার যোগ করুন।
  7. ঘরোয়া হেয়ার প্যাকের ব্যবহার করুন: রাসায়নিক পণ্যের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হেয়ার প্যাক ব্যবহার করুন।
    • মেথি ও দইয়ের প্যাক: সারা রাত ভিজিয়ে রাখা মেথি বেটে টক দইয়ের সাথে মিশিয়ে স্ক্যাল্পে ও চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রাখুন। এটি চুল পড়া কমাবে এবং খুশকি দূর করবে।
    • আমলকী ও অ্যালোভেরার প্যাক: আমলকীর রস এবং অ্যালোভেরা জেল একসাথে মিশিয়ে স্ক্যাল্পে লাগান। এটি চুলের গোড়া মজবুত করে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
  8. পর্যাপ্ত জল পান করুন: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন। এটি শুধু আপনার ত্বকই নয়, চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
  9. হিট স্টাইলিং থেকে দূরে থাকুন: বর্ষাকালে চুল দুর্বল থাকে। এই সময়ে হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেটনার বা কার্লারের মতো হিট স্টাইলিং টুল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে ড্রায়ারের 'কুল এয়ার' সেটিং ব্যবহার করুন।
  10. মানসিক চাপ কমান: অতিরিক্ত মানসিক চাপ চুল পড়ার অন্যতম একটি বড় কারণ। নিয়মিত যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা আপনার পছন্দের কোনো কাজ করে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন।


💐বোনাস টিপস: এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলুন

  • ভেজা চুল নিয়ে কখনো ঘুমাতে যাবেন না।
  • চুল খুব শক্ত করে বাঁধবেন না, বিশেষ করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে।
  • অতিরিক্ত রাসায়নিকযুক্ত হেয়ার কালার বা ট্রিটমেন্ট এই সময়ে এড়িয়ে চলুন।
  • অস্বাস্থ্যকর, ভাজাপোড়া ও জাঙ্ক ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।


💐প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ Section)

প্রশ্ন ১: বর্ষাকালে প্রতিদিন কি শ্যাম্পু করা উচিত?
উত্তর: না, প্রতিদিন শ্যাম্পু করলে স্ক্যাল্পের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট হয়ে যায় এবং চুল আরও শুষ্ক হয়ে পড়ে। সপ্তাহে ২-৩ দিন মাইল্ড শ্যাম্পু ব্যবহার করাই যথেষ্ট।

প্রশ্ন ২: চুল পড়া কমাতে কোন তেল সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: নারকেল তেল, ক্যাস্টর অয়েল এবং আমন্ড অয়েল চুল পড়া কমাতে খুব কার্যকরী। এর সাথে টি-ট্রি অয়েল বা রোজমেরি অয়েলের মতো এসেনশিয়াল অয়েল মিশিয়ে নিলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়।

প্রশ্ন ৩: কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত?
উত্তর: যদি ঘরোয়া উপায় অবলম্বনের পরেও চুল পড়ার পরিমাণ না কমে, স্ক্যাল্পে অতিরিক্ত চুলকানি বা ঘা দেখা যায়, অথবা অস্বাভাবিক পরিমাণে চুল পড়তে থাকে, তবে অবশ্যই একজন ডার্মাটোলজিস্ট বা ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।


💐শেষ কথা (Conclusion)

বর্ষা মানেই প্রকৃতির সজীবতা, তাই এই সময়ে চুল পড়ার সমস্যায় মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই। মনে রাখবেন, রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসে না। ধৈর্য ধরে উপরের নিয়মগুলো মেনে চললে এবং চুলের প্রতি একটু বাড়তি যত্নশীল হলে আপনিও এই বর্ষায় পেতে পারেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও মজবুত চুল।

এই বর্ষায় চুলের যত্ন নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ টিপস থাকলে Mumina blogs এ কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না!

*

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন