খরগোশ কি কি খাবার খায়? আপনার আদরের পোষ্যের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাবার তালিকা

বাড়িতে নতুন সদস্য এসেছে? অভিনন্দন! নতুন খরগোশ পালক হিসেবে আমাদের মনে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো – "ওকে কী খেতে দেব?" আপনার আদরের খরগোশটির সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করার জন্য সঠিক খাবার অপরিহার্য।

অনেকেই মনে করেন খরগোশের প্রধান খাবার হলো গাজর আর ভাত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জনপ্রিয় কার্টুনে দেখানো এই দৃশ্যটি খরগোশের জন্য একটি বড় ভুল ধারণা। এই ভুলের কারণে না জেনেই অনেকে তাদের আদরের পোষ্যের ক্ষতি করে ফেলেন, যার ফলে খরগোশ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

খরগোশ কি কি খাবার খায়? আপনার আদরের পোষ্যের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাবার তালিকা

চিন্তার কারণ নেই! এই আর্টিকেলে আমরা খরগোশের খাবার নিয়ে সমস্ত ভুল ধারণা ভেঙে দেব এবং একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ ও আদর্শ খাবার তালিকা তৈরি করে দেখাব, যা বাংলাদেশের বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। চলুন, আপনার আদরের বন্ধুটিকে একটি স্বাস্থ্যকর জীবন উপহার দেওয়ার যাত্রা শুরু করা যাক!


খরগোশের খাবারের পিরামিড: কোনটি কতটুকু প্রয়োজন?

খরগোশের খাবারকে একটি পিরামিডের মতো করে ভাবা যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা থাকবে পিরামিডের নিচে, আর সবচেয়ে কম যা প্রয়োজন, তা থাকবে উপরে। এই নিয়মটি মেনে চললেই আপনার খরগোশ থাকবে সুস্থ ও সবল।

খরগোশ কি কি খাবার খায়? আপনার আদরের পোষ্যের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাবার তালিকা

খাবারের অনুপাত:

  • খড় বা হে (Hay): ৮০-৯০%
  • তাজা শাক-সবজি: ১০-১৫%
  • পেলেটস: ৫%
  • ফল বা ট্রিটস: ০-৫% (খুবই অল্প)

১. খড় বা হে (Hay): ডায়েটের ৮০-৯০% (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ)

খরগোশের জন্য খড় বা শুকনো ঘাস হলো প্রধান এবং সবচেয়ে জরুরি খাবার। একে খরগোশের "সুপারফুড" বলা চলে।

কেন জরুরি?

  • দাঁতের স্বাস্থ্য: খরগোশের দাঁত মানুষের নখের মতো ক্রমাগত বাড়তে থাকে। খড় চিবানোর মাধ্যমে তাদের দাঁত প্রাকৃতিকভাবে ঘষা খেয়ে সঠিক আকারে থাকে এবং বড় হয়ে মুখে ক্ষত হওয়া থেকে বাঁচায়।
  • হজম প্রক্রিয়া: খড়ে থাকা ফাইবার খরগোশের হজম প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। এটি ডায়রিয়া এবং গ্যাসের মতো মারাত্মক সমস্যা প্রতিরোধ করে।

কোন ধরনের খড় দেবেন?

বাংলাদেশে সাধারণত সরাসরি "টিমোথি হে" বা "অ্যালফালফা হে" নামে খড় পাওয়া কঠিন হতে পারে। তবে এর চমৎকার কিছু বিকল্প রয়েছে:

  • শুকনো দূর্বা ঘাস: এটি খরগোশের জন্য একটি অসাধারণ খাবার এবং টিমোথি হে-র খুব কাছাকাছি। দূর্বা ঘাস শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে পারেন।
  • ধানের খড় (খুব সীমিত): ধানের খড় বা বিচালি দেওয়া যেতে পারে, তবে এটি খুব শক্ত হওয়ায় খরগোশের খেতে কষ্ট হতে পারে। নরম অংশ বেছে দিন।
  • প্যাক করা হে (Hay): বর্তমানে কিছু বড় পেট শপ বা অনলাইন স্টোরে খরগোশের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হে পাওয়া যায়।

পরামর্শ: আপনার খরগোশের খাঁচায় বা থাকার জায়গায় সারাদিন যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে তাজা ও শুকনো খড় থাকে, তা নিশ্চিত করুন। খড়ই তার প্রধান খাবার, অন্য কিছু নয়।


২. তাজা শাক-সবজি (Fresh Vegetables): ডায়েটের ১০-১৫%

প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের তাজা শাক-সবজি খরগোশের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলস সরবরাহ করে।

নিরাপদ সবজির তালিকা (যা বাংলাদেশে সহজলভ্য):

  • ধনে পাতা: খরগোশের অত্যন্ত পছন্দের এবং নিরাপদ একটি খাবার।
  • পুদিনা পাতা: হজমের জন্য দারুণ উপকারী।
  • কলমি শাক: পরিমিত পরিমাণে দেওয়া যেতে পারে।
  • সজনে পাতা: পুষ্টিগুণে ভরপুর, তবে অল্প পরিমাণে দিন।
  • গাজরের পাতা: গাজরের চেয়ে এর পাতা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
  • পালং শাক: আয়রন সমৃদ্ধ, তবে ক্যালসিয়াম বেশি থাকায় সপ্তাহে ২-৩ দিনের বেশি নয়।
  • ব্রকলি: অল্প পরিমাণে দেওয়া যায়, তবে বেশি দিলে গ্যাস হতে পারে।
  • বেল পেপার বা ক্যাপসিকাম (সবুজ): এটিও একটি ভালো বিকল্প।

পরামর্শ: প্রতিদিন অন্তত ৩ ধরনের সবজি মিশিয়ে এক কাপ পরিমাণ দিন। নতুন কোনো সবজি দেওয়ার আগে অল্প একটু দিয়ে দেখুন তার হজমে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না।


৩. পেলেটস (Pellets): ডায়েটের ৫% (অতিরিক্ত পুষ্টির জন্য)

পেলেটস হলো খরগোশের জন্য তৈরি করা এক ধরনের  (supplementary) খাবার। এটি খড় বা সবজির বিকল্প নয়, বরং সহায়ক।

সঠিক পেলেটস চেনার উপায়:

  • হাই-ফাইবার: প্যাকেটের গায়ে লেখা উপকরণের তালিকা দেখুন। কমপক্ষে ১৮% ফাইবার থাকা জরুরি।
  • রঙিন নয়: রঙিন, বীজ, বাদাম বা শস্যদানা মিশ্রিত পেলেটস (যাকে মিক্সড ফিড বলে) খরগোশের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণ দেখতে বাদামী রঙের পেলেটস কিনুন।
  • ব্র্যান্ড: বাংলাদেশে "Rabbito," "Versele-Laga," বা "Oxbow" (যদি পাওয়া যায়) ভালো মানের পেলেটস তৈরি করে।

পরিমাণ: একটি প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের (প্রায় ২ কেজি ওজনের) জন্য প্রতিদিন প্রায় ২ টেবিল চামচ (আনুমানিক ২৫ গ্রাম) পেলেটস যথেষ্ট। এর বেশি দেওয়া উচিত নয়।


৪. স্বাস্থ্যকর ট্রিটস বা ফল (Healthy Treats): ডায়েটের ০-৫% (খুবই অল্প পরিমাণে)

ফল খরগোশের জন্য ক্যান্ডির মতো। এটি নিয়মিত খাবার নয়, কেবল ভালোবাসার প্রকাশ বা পুরস্কার হিসেবে অল্প পরিমাণে দেওয়া উচিত।

নিরাপদ ফলের তালিকা:

  • আপেল: অবশ্যই বীজ ফেলে দিয়ে ছোট এক টুকরো।
  • কলা: খুব সামান্য (এক চাকতির অর্ধেক)।
  • পেঁপে: হজমের জন্য ভালো, ছোট এক টুকরো।
  • আনারস: ছোট এক টুকরো।
  • স্ট্রবেরি: একটির অর্ধেক।

সতর্কতা: ফলে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে, যা খরগোশের পেটে খারাপ ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে সাহায্য করে, দাঁত নষ্ট করে এবং ওজন বাড়িয়ে দেয়। সপ্তাহে ২-৩ বারের বেশি ফল দেবেন না এবং প্রতিবার এক চা চামচের বেশি নয়।


একটি আদর্শ দৈনিক খাবার তালিকা (নমুনা)

এখানে ২ কেজি ওজনের একটি প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের জন্য নমুনা রুটিন দেওয়া হলো:

সময় খাবার পরিমাণ
সারাদিন শুকনো দূর্বা ঘাস বা হে আনলিমিটেড / লিমিটেড (যত খুশি খেতে দিন)
সকাল (৮টা) পেলেটস ২ টেবিল চামচ
দুপুর (২টা) তাজা শাক-সবজি ১ কাপ (ধনে পাতা, পুদিনা, কলমি শাক মিশিয়ে)
রাত (৮টা) ট্রিট (ঐচ্ছিক) ১ চা চামচ পেঁপের টুকরো (সপ্তাহে ২-৩ দিন)
সারাদিন বিশুদ্ধ পানি সব সময় সহজলভ্য রাখতে হবে


বিপদজনক খাবার! যে খাবারগুলো খরগোশকে কখনোই দেবেন না

এই সেকশনটি আপনার খরগোশের জীবন বাঁচাতে পারে। নিচের খাবারগুলো খরগোশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, এমনকি বিষাক্ত।

◇বিপজ্জনক খাবারের তালিকা:

  • ভাত, রুটি, মুড়ি, বিস্কুট: যেকোনো ধরনের শস্যদানা খরগোশের হজম প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে।
  • আলু, মিষ্টি আলু: স্টার্চযুক্ত খাবার এদের জন্য বিষাক্ত।
  • দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য: খরগোশ ল্যাকটোজ হজম করতে পারে না।
  • চকলেট, কফি, চা: ক্যাফেইন এদের হৃদপিণ্ডের জন্য মারাত্মক।
  • আইসবার্গ লেটুস: এতে কোনো পুষ্টি নেই এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
  • পেঁয়াজ, রসুন: রক্তকণিকা নষ্ট করে দেয়।
  • অ্যাভোকাডো: এটি খরগোশের জন্য বিষ।
  • যেকোনো ধরনের রান্না করা খাবার।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ Section)

প্রশ্ন ১: খরগোশকে কি গাজর দেওয়া যাবে?

উত্তর: হ্যাঁ, তবে এটি একটি ট্রিট, প্রধান খাবার নয়। গাজরে প্রচুর চিনি থাকে। সপ্তাহে এক বা দুইবার আঙুলের এক ইঞ্চি পরিমাণ দিতে পারেন, তার বেশি নয়।


প্রশ্ন ২: আমার খরগোশ শুকনো ঘাস/খড় খেতে চায় না, কী করব?

উত্তর: এটি একটি সাধারণ সমস্যা। প্রথমে পেলেটস এবং সবজির পরিমাণ কমিয়ে দিন। ক্ষুধা পেলে সে নিজে থেকেই খড় খাওয়া শুরু করবে। খড়ের উপরে সামান্য ধনে পাতা ছড়িয়ে দিয়েও চেষ্টা করতে পারেন।


প্রশ্ন ৩: বাচ্চা খরগোশের খাবার কি আলাদা?

উত্তর: হ্যাঁ। ৭ মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চা খরগোশের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বেশি প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। তাদের অ্যালফালফা-ভিত্তিক পেলেটস এবং অ্যালফালফা হে (যদি পাওয়া যায়) দেওয়া উচিত। না পেলে, নরম দূর্বা ঘাসের সাথে পেলেটসের পরিমাণ সামান্য বেশি রাখতে হবে।


প্রশ্ন ৪: খরগোশকে কতটা পানি দিতে হবে?

উত্তর: খরগোশের জন্য সব সময় তাজা ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাটিতে করে পানি দিলে তারা বোতলের চেয়ে বেশি পান করে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। প্রতিদিন পানি পরিবর্তন করে দিন।


উপসংহার (Conclusion):

পরিশেষে, একটি সুখী ও স্বাস্থ্যবান খরগোশের মূল চাবিকাঠি হলো একটি খড়-ভিত্তিক (Hay-based) ডায়েট। ৮০% খড়, ১৫% সবজি, এবং ৫% পেলেটস—এই সহজ সূত্রটি মনে রাখলেই আপনার খরগোশের পুষ্টির প্রায় সব চাহিদা পূরণ হবে।

প্রতিটি খরগোশ একে অপরের থেকে কিছুটা আলাদা হতে পারে। আপনার খরগোশের স্বাস্থ্যের বিষয়ে কোনো সন্দেহ বা অস্বাভাবিক কিছু দেখলে দেরি না করে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ পশুচিকিৎসকের (Veterinarian) পরামর্শ নিন।

সঠিক যত্ন ও ভালোবাসায় আপনার আদরের এই ছোট্ট বন্ধুটি বহু বছর ধরে আপনার ঘর আনন্দে ভরিয়ে রাখবে। Mumina blogs এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!

*

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন