গত রাতেও মোবাইল স্ক্রল করতে করতে কখন যে ৩টে বেজে গেল, টেরই পেলাম না। সকালে উঠে ঘাড় ব্যথা আর ক্লান্ত চোখ নিয়ে যখন দিনটা শুরু হলো, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বকা দিলাম। আপনার সাথেও কি এমন হয়? দিনের শেষে মনে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু মোবাইলের পেছনেই নষ্ট হলো?
আপনি একা নন। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম আজ আমাদের প্রায় সবারই সমস্যা। এর কারণে শুধু যে আমাদের ঘুম নষ্ট হচ্ছে বা চোখে চাপ পড়ছে তা-ই নয়, এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার আমাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং একাকীত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারে।
কিন্তু ভালো খবর হলো, এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আমিও এই সমস্যায় बुरीভাবে জর্জরিত ছিলাম। তবে নিজের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এমন ৫টি সহজ কিন্তু কার্যকরী কৌশল খুঁজে পেয়েছি, যা আমার স্ক্রিন টাইমকে নিয়ন্ত্রণে আনতে দারুণভাবে সাহায্য করেছে। আজ সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আপনাদের জানাবো, কীভাবে আপনিও মোবাইলের আসক্তি কমিয়ে জীবনকে আরও সুন্দর করতে পারেন।
১. ডিজিটাল ডিটক্স: সপ্তাহে একদিন মোবাইলকে 'না' বলুন
যখনই স্ক্রিন টাইম কমানোর কথা ভাবতাম, প্রথম যে ভয়টা কাজ করত তা হলো— "যদি জরুরি কিছু মিস করে ফেলি?" এই ভয় কাটানোর সেরা উপায় হলো ডিজিটাল ডিটক্স।
পরামর্শ:
ডিজিটাল ডিটক্স মানে কঠিন কিছু নয়। শুধু সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিন, যেমন শুক্রবার বা শনিবার, কয়েক ঘণ্টার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বা অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে রাখা। এই সময়টুকু নোটিফিকেশনের শব্দ বা ভাইব্রেশনের চিন্তা ছাড়া কাটান।
আমার অভিজ্ঞতা:
প্রথমদিকে আমার জন্য এটা খুব কঠিন ছিল। প্রতি মিনিটে ফোন চেক করার একটা তীব্র ইচ্ছা হতো। কিন্তু আমি নিজেকে জোর করে পুরনো শখের দিকে ফিরিয়ে নিই। ধুলো পড়া গিটারটা বের করে টুং টাং করি, কখনও বা মায়ের সাথে বসে মন খুলে গল্প করি। বিশ্বাস করুন, কয়েক সপ্তাহ পর এই "ডিজিটাল ডিটক্স" আমার সাপ্তাহিক রুটিনের সবচেয়ে প্রিয় অংশে পরিণত হয়। মানসিক শান্তি যে কী, তা আমি সেদিনই নতুন করে অনুভব করি।
২. নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ: যা প্রয়োজন শুধু তাই দেখুন
আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় কারিগর হলো ফোনের নোটিফিকেশন। (Tik) করে একটি শব্দ হলো, আর আমরা সব কাজ ফেলে ফোনের দিকে ছুটলাম।
পরামর্শ:
একবার আপনার ফোনের সেটিংসে গিয়ে দেখুন, কতগুলো অ্যাপ আপনাকে নোটিফিকেশন পাঠানোর অনুমতি নিয়ে রেখেছে। শপিং অ্যাপ, গেমস বা নিউজ অ্যাপের মতো যেসব অ্যাপের নোটিফিকেশন খুব জরুরি নয়, সেগুলো বন্ধ করে দিন। শুধু কল, মেসেজ বা ইমেইলের মতো জরুরি অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন চালু রাখুন।
আমার অভিজ্ঞতা:
আমার ফোনে প্রায় ৩০টির বেশি অ্যাপের নোটিফিকেশন অন ছিল। যখন আমি অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিলাম, অবাক হয়ে দেখলাম আমার ফোন হাতে নেওয়ার পরিমাণ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এখন আমার মনোযোগ আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এবং কোনো কাজে আগের থেকে অনেক ভালোভাবে মন দিতে পারি।
৩. ঘুমের আগে এক ঘণ্টা 'নো-মোবাইল' জোন
রাতে ঘুম আসে না? এর জন্য অনেকাংশে দায়ী আপনার প্রিয় স্মার্টফোনটি।
পরামর্শ:
বিজ্ঞান বলছে, মোবাইলের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো (Blue Light) আমাদের মস্তিষ্কে ঘুমের জন্য দায়ী মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে, আমাদের ঘুম আসতে দেরি হয় এবং ঘুমের গভীরতাও কমে যায়। তাই, সুস্থ ঘুমের জন্য ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করুন। এই নিয়মটিকে আপনার বেডরুমের জন্য একটি আইন বানিয়ে ফেলুন।
আমার অভিজ্ঞতা:
আগে আমি বিছানায় শুয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখতাম, যা আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। এখন আমি ঘুমানোর আগে ফোনটা অন্য ঘরে চার্জে দিয়ে একটি বই পড়ি। প্রথম কয়েকদিন খুব অস্বস্তি হয়েছিল, কিন্তু এখন আমি আগের থেকে অনেক গভীর এবং শান্তিতে ঘুমাতে পারি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর যে ফুরফুরে অনুভূতি হয়, তার কোনো তুলনা হয় না।
৪. বাস্তব জীবনে নতুন হবি তৈরি করুন
মোবাইল আমাদের তখনই বেশি টানে, যখন আমাদের হাতে আর কোনো কাজ থাকে না। এই শূন্যতা পূরণ করার সেরা উপায় হলো নতুন কোনো শখ বা হবি তৈরি করা।
পরামর্শ:
এমন কিছু করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয় এবং মোবাইল থেকে দূরে রাখে। সেটা হতে পারে বাগান করা, রান্না শেখা, সাইক্লিং, ছবি আঁকা অথবা পরিবারের সাথে লুডো বা ক্যারামের মতো ইনডোর গেম খেলা।
আমার অভিজ্ঞতা:
আমার অবসর সময় কাটত ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করে। আমি সেই সময়টা এখন ছাদে একটি ছোট সবজি বাগান করার পেছনে দিচ্ছি। নিজের হাতে লাগানো গাছের যত্ন নেওয়ার আনন্দ, গাছগুলোর বেড়ে ওঠা দেখা আমাকে ফোনের আকর্ষণ থেকে অনেকটাই দূরে রেখেছে। এই শখটি আমার মানসিক প্রশান্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
৫. স্ক্রিন টাইম মনিটরিং অ্যাপ ব্যবহার করুন
"চোরকে ধরতে হলে, আগে জানতে হবে সে কখন আসে।" ঠিক তেমনই, স্ক্রিন টাইম কমাতে হলে আগে জানতে হবে আপনার সময় ঠিক কোথায় যাচ্ছে।
পরামর্শ:
অ্যান্ড্রয়েড ফোনের "Digital Wellbeing" বা আইফোনের "Screen Time" ফিচারটি ব্যবহার করুন। এই টুলগুলো আপনাকে দেখিয়ে দেবে আপনি কোন অ্যাপে দিনে বা সপ্তাহে কত ঘণ্টা সময় ব্যয় করছেন। শুধু তাই নয়, আপনি চাইলে প্রতিটি অ্যাপের জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের সময়সীমাও বেঁধে দিতে পারেন।
আমার অভিজ্ঞতা:
আমি যখন প্রথম আমার স্ক্রিন টাইম চেক করি, দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছিলাম! আমি দিনে প্রায় ৫ ঘণ্টা শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই নষ্ট করি। এই অ্যাপ আমাকে আমার ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করেছে। আমি যখন ফেসবুকের জন্য দৈনিক ৪৫ মিনিটের একটি সীমা বেঁধে দিলাম, প্রথমদিকে কষ্ট হলেও এখন আমি অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত এবং প্রোডাক্টিভ।
বোনাস টিপস
- ডাইনিং টেবিলকে 'নো-ফোন' জোন বানান: খাওয়ার সময় পরিবারের সাথে কথা বলুন, খাবারের স্বাদ নিন।
- স্ক্রিন সাদা-কালো করুন: ফোনের কালারফুল স্ক্রিন আমাদের বেশি আকর্ষণ করে। সেটিংসে গিয়ে ফোনের স্ক্রিন Grayscale বা সাদা-কালো করে রাখলে এর আকর্ষণ অনেকটাই কমে যায়।
শেষ কথা
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু এর দাস হয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মোবাইলের স্ক্রিন টাইম কমানো মানে জীবন থেকে প্রযুক্তিকে বাদ দেওয়া নয়, বরং এর সঠিক এবং পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।
উপরে বলা ৫টি কৌশল আমার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। প্রথমদিকে হয়তো একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ছোট ছোট এই পদক্ষেপগুলোই আপনার জীবনে বড় পরিবর্তন আনবে। আপনার হাতে থাকা সময়টুকু ভার্চুয়াল জগতের বদলে বাস্তব জীবনে ব্যয় করুন, দেখবেন জীবনটা আরও কত সুন্দর!
এবার আপনার পালা! স্ক্রিন টাইম কমাতে আপনি কোন কৌশলটি আজই চেষ্টা করে দেখবেন? আপনার কোনো ব্যক্তিগত টিপস থাকলে নিচের কমেন্ট বক্সে আমাদের সাথে শেয়ার করুন।