কখনো কি ভেবে দেখেছেন আপনার পিরিয়ড কেন নিজের খেয়ালখুশিমতো চলে? অথবা, নিয়মিত চক্র হঠাৎ করে কেন অনিয়মিত হয়ে যায়? মাসিক চক্র একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য, আর মাঝে মাঝে এটি তার ছন্দ হারায়। সাধারণত, একটি নিয়মিত পিরিয়ড ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে হয় এবং এর রক্তপাতের ধরনও কমবেশি একই থাকে। কিন্তু যখন পিরিয়ড দেরিতে আসে, আগে হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মিস হয়, অস্বাভাবিক বেশি বা কম রক্তপাত হয়, অথবা দুই পিরিয়ডের মাঝখানে রক্তপাত দেখা যায়, তখন তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলে।
অনিয়মিত পিরিয়ড একটি সাধারণ সমস্যা এবং এটি নারী জীবনে উদ্বেগ বা বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। অনেক সময় এর পেছনে বেশ কিছু কারণ লুকিয়ে থাকে, যা শারীরিক বা মানসিক উভয়ই হতে পারে। এই ব্লগ পোস্টটির উদ্দেশ্য হলো অনিয়মিত মাসিকের পেছনের সমস্ত সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানো, যাতে আপনি আপনার শরীরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। মনে রাখবেন, এই তথ্য শুধুমাত্র সচেতনতার জন্য, এটি কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যায় অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১: হরমোন ঘটিত কারণ – এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের সমস্যা
আমাদের শরীরের হরমোনগুলো মাসিক চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি এই হরমোনগুলোর ভারসাম্যে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে।
১.১ পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS):
PCOS বর্তমানে নারীদের মধ্যে একটি অত্যন্ত সাধারণ হরমোনজনিত সমস্যা। এতে প্রজনন হরমোনগুলোর ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটে, যার ফলে ডিম্বাশয়ে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হতে পারে। এই সিস্টগুলো ডিম্বস্ফোটনে বাধা দেয়, যার কারণে মাসিক অনিয়মিত, দেরিতে বা দীর্ঘায়িত হতে পারে। PCOS-এর অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপ্রত্যাশিত ওজন বৃদ্ধি, ব্রণ, এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অবাঞ্ছিত লোমের আধিক্য।
১.২ থাইরয়েড কর্মহীনতা (হাইপোথাইরয়েডিজম ও হাইপারথাইরয়েডিজম):
থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর হরমোনগুলো মাসিক চক্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
- হাইপোথাইরয়েডিজম (কম সক্রিয় থাইরয়েড): থাইরয়েড হরমোনের অভাবে মাসিক ভারী, ঘনঘন, দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে অথবা মাসিক মিস হতে পারে।
- হাইপারথাইরয়েডিজম (বেশি সক্রিয় থাইরয়েড): অন্যদিকে, থাইরয়েড হরমোন বেশি থাকলে মাসিক হালকা বা অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১.৩ উচ্চ প্রোল্যাকটিন মাত্রা (হাইপারপ্রোল্যাকটিনেমিয়া):
প্রোল্যাকটিন এমন একটি হরমোন যা মূলত স্তন্যদুগ্ধ উৎপাদনে জড়িত। যদি এই হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এটি অন্যান্য প্রজনন হরমোনকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রোল্যাকটিনের উচ্চ মাত্রা ইস্ট্রোজেনকে দমন করে এবং ডিম্বস্ফোটনে বাধা দেয়, যার ফলস্বরূপ অনিয়মিত বা এমনকি মাসিক বন্ধ (অ্যামেনোরিয়া) হয়ে যেতে পারে।
১.৪ পেরিমেনোপজ:
পেরিমেনোপজ হলো মেনোপজের (যখন মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়) ঠিক আগের পর্যায়। সাধারণত মহিলাদের বয়স ৩০-এর শেষ থেকে ৫০-এর দশকের মধ্যে এই পর্যায় শুরু হয়। এই সময়ে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করে, যার কারণে মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে পড়ে। পিরিয়ড কখনও ছোট, কখনও দীর্ঘ, আবার কখনও হালকা বা ভারী হতে পারে।
২: জীবনধারা ও পরিবেশগত কারণ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং পরিবেশগত কিছু বিষয়ও মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করতে পারে।
২.১ উল্লেখযোগ্য ওজন পরিবর্তন (বৃদ্ধি বা হ্রাস):
শরীরের চর্বি আমাদের হরমোন উৎপাদনে সরাসরি ভূমিকা রাখে।
- অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি: শরীরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গেলে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং মাসিককে অনিয়মিত করে তোলে।
- উল্লেখযোগ্য ওজন হ্রাস/কম ওজন: অন্যদিকে, অত্যাধিক ওজন কমে গেলে বা শরীরের চর্বি খুব কম থাকলে ইস্ট্রোজেন উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা শরীরকে প্রজননের জন্য প্রস্তুত নয় এমন সংকেত দেয়, ফলে প্রায়শই মাসিক বন্ধ হয়ে যায় বা খুব অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
২.২ অতিরিক্ত ব্যায়াম:
যারা অতিরিক্ত কঠোর বা দীর্ঘক্ষণ ধরে শারীরিক কার্যকলাপ করেন, বিশেষ করে ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে, এটি প্রজনন হরমোন (ইস্ট্রোজেন) দমন করতে পারে। এর ফলে "অ্যাথলেটিক অ্যামেনোরিয়া" (মাসিক অনুপস্থিতি) বা "অলিগোমেনোরিয়া" (অনিয়মিত মাসিক) দেখা দিতে পারে। সাধারণত এটি কম শরীরের চর্বির সাথে সম্পর্কিত।
২.৩ মানসিক চাপ (শারীরিক ও মানসিক):
আমাদের শরীরের "লড়াই বা পালানো" (fight or flight) প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসকে প্রভাবিত করে। হাইপোথ্যালামাস মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মাসিক চক্র সহ শরীরের অনেক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। উচ্চ মানসিক চাপ ডিম্বস্ফোটনের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন সংকেতকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলস্বরূপ মাসিক বিলম্বিত, বাদ যাওয়া বা একেবারেই অনুপস্থিত হতে পারে।
২.৪ দুর্বল পুষ্টি/খাদ্য গ্রহণজনিত ব্যাধি (Eating Disorders):
যদি শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি না পায় বা অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা বা বুলিমিয়ার মতো খাদ্য গ্রহণজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহলে মাসিক অনিয়মিত হতে পারে। পর্যাপ্ত শক্তি এবং পুষ্টির অভাবে শরীর হরমোন তৈরি করতে পারে না, যা একটি সুস্থ মাসিক চক্রের জন্য অপরিহার্য। এর ফলে প্রায়শই অ্যামেনোরিয়া (মাসিক অনুপস্থিতি) হয়।
৩: প্রজনন ও অন্যান্য চিকিৎসাগত অবস্থা
কিছু প্রজনন সংক্রান্ত অবস্থা এবং অন্যান্য চিকিৎসাগত সমস্যাও অনিয়মিত মাসিকের কারণ হতে পারে।
৩.১ গর্ভধারণ:
মাসিক মিস হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো গর্ভধারণ। একবার গর্ভবতী হলে, শরীর ডিম্বস্ফোটন বন্ধ করে দেয় এবং মাসিক আসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে হালকা দাগ (implantation bleeding) হতে পারে, যা অনেক সময় মাসিকের ভুল হতে পারে।
৩.২ স্তন্যপান:
স্তন্যপান করানোর সময় প্রোল্যাকটিন হরমোনের মাত্রা বেশি থাকে, যা দুধ উৎপাদনের জন্য দায়ী। এই হরমোন ডিম্বস্ফোটনকে দমন করতে পারে। সক্রিয় স্তন্যপানের সময় মাসিক প্রায়শই অনিয়মিত বা অনুপস্থিত থাকে। স্তন্যপান বন্ধ করার বা কমানোর পর চক্র স্বাভাবিক হতে কিছু সময় লাগতে পারে।
৩.৩ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (হরমোনজনিত):
জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হরমোনজনিত পদ্ধতিগুলো (যেমন - পিল, প্যাচ, ইনজেকশন, ইমপ্লান্ট এবং হরমোনজনিত আইইউডি) মাসিকের নিয়মিততাকে প্রভাবিত করতে পারে।
- প্রাথমিক সামঞ্জস্য: নতুন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি শুরু করার প্রথম কয়েক মাসে অনিয়মিত রক্তপাত বা দাগ দেখা যাওয়া খুবই সাধারণ।
- নির্দিষ্ট পদ্ধতি: কিছু পদ্ধতি (যেমন ডেপো-প্রোভার ইনজেকশন, হরমোনজনিত আইইউডি) খুব হালকা মাসিক, অনিয়মিত মাসিক বা একেবারেই মাসিক না হওয়ার কারণ হতে পারে।
- জন্ম নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা: হরমোনজনিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করার পর শরীর পুনরায় নিজেকে সামঞ্জস্য করতে কয়েক মাস সময় নিতে পারে, ফলে এই সময়ে মাসিক অনিয়মিত থাকতে পারে।
৩.৪ ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড বা পলিপ:
ফাইব্রয়েড বা পলিপ হলো জরায়ুতে হওয়া অ-ক্যান্সারজনিত বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধিগুলো জরায়ুর আস্তরণ এবং রক্ত প্রবাহকে প্রভাবিত করে, যার ফলে মাসিক ভারী হতে পারে, দীর্ঘায়িত হতে পারে অথবা পিরিয়ডের মাঝখানেও রক্তপাত দেখা দিতে পারে।
৩.৫ এন্ডোমেট্রিওসিস:
এন্ডোমেট্রিওসিস এমন একটি অবস্থা যেখানে জরায়ুর ভেতরের আস্তরণের মতো টিস্যু জরায়ুর বাইরে বৃদ্ধি পায়। এটি খুব বেদনাদায়ক, ভারী এবং দীর্ঘায়িত মাসিকের কারণ হতে পারে এবং কখনও কখনও অনিয়মিত রক্তপাতও ঘটায়।
৩.৬ পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID):
PID হলো প্রজনন অঙ্গগুলির একটি সংক্রমণ, যা প্রায়শই যৌনবাহিত সংক্রমণের (STIs) কারণে হয়। এটি অনিয়মিত রক্তপাত, ভারী মাসিক এবং শ্রোণীতে তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে।
৩.৭ প্রিম্যাচিউর ওভারিয়ান ইনসাফিসিয়েন্সি (POI):
এই অবস্থায় ডিম্বাশয় ৪০ বছর বয়সের আগেই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যেহেতু ডিম্বাশয় পর্যাপ্ত ইস্ট্রোজেন তৈরি করে না, তাই মাসিক অনিয়মিত হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, যা মেনোপজের প্রাথমিক শুরু হিসাবে পরিচিত।
৩.৮ কিছু ঔষধ:
কিছু ঔষধ মাসিকের নিয়মিততাকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত পাতলা করার ঔষধ, থাইরয়েডের ঔষধ, এন্টিডিপ্রেসেন্ট এবং স্টেরয়েড মাসিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
আপনার জন্য প্রশ্ন
এই অংশটি আপনাকে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আরও গভীরভাবে ভাবতে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করতে সাহায্য করবে:
- আপনার পিরিয়ড কি সম্প্রতি অনিয়মিত হয়েছে?
- আপনার জীবনধারায় কি কোনো বড় পরিবর্তন এসেছে (যেমন: ওজন, মানসিক চাপ, ব্যায়ামের ধরণ)?
- আপনি কি নতুন কোনো ঔষধ গ্রহণ করছেন বা কোনো জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন?
- আপনার অনিয়মিত পিরিয়ডের সাথে কি অন্য কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে (যেমন: অতিরিক্ত ব্যথা, ব্রণ, চুল পড়া)?
- আপনার পরিবারে কি কারো PCOS বা থাইরয়েড সমস্যার ইতিহাস আছে?
শেষ কথা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হলো: যদি আপনার পিরিয়ড অনিয়মিত হয় এবং আপনি এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন হন, তবে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসকের সঠিক রোগ নির্ণয় এবং ব্যক্তিগত পরামর্শ আপনাকে সঠিক পথে চালিত করবে। আপনার শরীরকে বুঝুন, তার কথা শুনুন এবং প্রয়োজনে সঠিক পদক্ষেপ নিন। মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্যই আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ।